বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আসসালামু আলাইকুম

আপনারা সকলে জানেন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন পরিচালিত বাংলাদেশী পতাকবাহী এম ভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে গত ২রা মার্চ ইউক্রেনের অলিভিয়া পোর্টে বহিঃ নোঙ্গরে অবস্থানরত অবস্থায় বাংলাদেশ সময়ে আনুমানিক রাত ৯টা ২৫ মিনিটে রকেট হামলা হয়। রকেট হামলার ফলে জাহাজের নেভিগেশন ব্রীজে ভয়াবহভাবে আগুন ধরে যায়। জাহাজের কর্মরত সকল নাবিক অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে আগুন নির্বাপনে সক্ষম হন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে ভয়ংকর এই রকেট হামলায় জাহাজে কর্মরত তৃতীয় প্রকৌশলী আমাদের প্রানপ্রিয় ভাই মোহাম্মদ হাদিসুর রহমান নির্মমভাবে আগুনে পুড়ে নিহত হন। মোহাম্মাদ হাদিসুর রহমান বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীর ৪৭তম ব্যাচের এক্স ক্যাডেট এবং বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলার হোসনাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। তার পরিবারে বাবা-মা এবং ৩ ভাই ও ১ বোন রয়েছে। তাঁর হৃদয় বিদারক পরিনতির জন্য আমরা অত্যন্ত শোকাহত। আমরা মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে তাঁর রূহের মাগফেরাত কামনা করছি।

উল্লেখিত ১৮০ মিটারের দীর্ঘ বাল্ক ক্যারিয়ার এম ভি বাংলার সমৃদ্ধি তুরস্ক থেকে গত ২২শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরের জলসীমায় নোঙ্গর করে। দূর্ভাগ্যবশতঃ গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি উদ্ভূত হলে অলিভিয়া বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায় এবং জাহাজটি ২৯ জন নাবিক নিয়ে ওখানেই নোঙ্গর করা অবস্থায় আটকা পড়ে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স এসোসিয়েশন-কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগ

গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০২২ইং তারিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত একটি মেসেজ দেখে আমরা প্রথমে জানতে পারি এমভি বাংলার সমৃদ্ধি ওলিভিয়া বন্দরে আটকে পড়ার ঘটনা। ততক্ষণাত আমাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) দায়িত্বশীল কর্মকতার সাথে যোগাযোগ করা হয়। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এ ব্যাপারে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে এবং নিয়মিত জাহাজের সাথে যোগাযোগ রাখছে বলে এসোসিয়েশনকে অবহিত করে।

International Transport Workers’ Federation (ITF)-এর অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স এসোসিয়েশন (BMMOA) গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ইং তারিখে “এমভি বাংলার সমৃদ্ধি”জাহাজের নিরাপত্তার নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে ITF-কে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অবহিত করে। ITF বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে সরাসরি IMO-এর নিকট উপস্থাপন করে এবং IMO-কে দ্রুত সকল ধরণের সহযোগীতা করার জন্য অনুরোধ করে। এছাড়াও ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিস্থিতির উদ্ভুত হওয়ার কারণে আটকে পড়া বিভিন্ন দেশের জাহাজগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য ITF একটি বিশেষ সেল গঠন করেছে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স এসোসিয়েশন (BMMOA) নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মাননীয় মহাপরিচালক-এর সাথে যোগাযোগ করে সরকারিভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার জন্য পরামর্শ প্রদান করে। এছাড়াও এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মাননীয় পরিচালককে নৌপরিবহন অধিদপ্তর, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ ইউক্রেন এবং রাশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশের সকল সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাহাজটিকে নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য তাগিদ দেয়া হয়। সেই সাথে International Maritime Organization (IMO)UN Agency For Maritime Affairs-কেও বিষয়টি অবহিত করার জন্য বলা হয়েছে।

এছাড়াও আমরা ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে আটকে পড়া “এমভি বাংলার সমৃদ্ধি” থেকে নিহত নাবিকের মরদেহ সহ জীবিত সকল নাবিকদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তর-কে ই-মেইল ও লিখিত পত্র প্রেরণ করি।

জাহাজ হতে নাবিকগণ তাদের অবস্থা নিরাপদ নয় এবং অতিদ্রুত তাদের উদ্ধারের জন্য আমাদের নিকট অনুরোধ করতে থাকে। আমরা স্ব-উদ্যোগে তাদের উদ্ধারে বিভিন্ন উপায় খুঁজতে থাকি। এমতাবস্থায় একটি বেসরকারি সংস্থা আমাদের প্রস্তাব দেয় যে, তারা বাংলার সমৃদ্ধির নাবিকদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে হস্থান্তর করতে পারবেন। বিষয়টি আমাদের এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মাননীয় মহাপরিচালকে অবহিত করা হয় এবং তাদের উভয়ের মধ্যে পরিচিতি ও যোগাযোগ করিয়ে দিই। এভাবেই নাবিকদের উদ্ধার কার্যক্রমের উদ্যোগ শুরু হয়। পরবর্তীতে এই বেসরকারি সংস্থা নাবিকদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করে। তাদের সাথে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। ইনশাল্লাহ্ এই বেসরকারী সংস্থাই নাবিকদের পোল্যান্ড-এ অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে পৌছে দিবে।

আমাদের কিছু প্রশ্ন

০১। এই মুহুর্তে আমাদের এসোসিয়েশন থেকে প্রশ্ন জাহাজটি জেনে-বুঝে কেন এই যুদ্ধ কবলিত অঞ্চলে প্রবেশ করল? যেখানে ১৫ই ফেব্রুয়ারি Joint War Committee কর্তৃক জায়গাটিকে যুদ্ধ কবলিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর জাহাজটি নোঙ্গর করে ২২শে ফেব্রুয়ারি। যা সম্পূর্ণ প্রশ্নবিব্ধ!

০২। Charterer Party বিধি মালা অনুযায়ী কোন জাহাজ কোম্পানী তার জাহাজের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধ কবলিত এবং জলদস্যু প্রবণ এলাকাতে জাহাজ গমনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি/আরোপ করতে পারে। এক্ষেত্রে জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষ বিএসসি-এর পক্ষ থেকে কে জাহাজটিকে যুদ্ধ কবলিত এলাকায় গমনের অনুমতি দিল?

০৩। জাহাজটি যুদ্ধ কবলিত এলাকায় আটকে যাওয়ার পর জাহাজটির নাবিকদের নিরাপদে সরিয়ে আনার কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় নি।

০৪। মোহাম্মদ হাদিসুর রহমান আমাদের প্রাণপ্রিয় সহকর্মীর মরদেহ কীভাবে দেশে প্রর্ত্যাবর্তন করা হবে?

০৫। জাহাজ পরিচালনায় বিএসসির সার্বিক অব্যস্থাপনার কারনে আমাদের আজকে এই মৃত্যু ও নাবিকদের দুর্দশা দেখতে হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় মহা মূল্যবান সম্পত্তি “এমভি বাংলার সমৃদ্ধি”-র এই চরম ক্ষয়-ক্ষতি  হয়েছে। এই মৃত্যুর দায় কে নিবে? এই ক্ষয়-ক্ষতির দায় কে নিবে?

আমাদের দাবি

০১। মোহাম্মদ হাদিসুর রহমানকে রাষ্ট্রীয় বীর ঘোষণা করা হোক এবং তার মরদেহ দেশে আনুন, আমরা এদেশের মাটিতে তার দাফন করতে চাই।

০২। ২৮ জন জীবিত নাবিকদের অতিদ্রুত নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনুন এবং তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করুন।

০৩। বিএসসি কর্তৃক জাহাজ পরিচালনায় যে গাফিলতি হয়েছে তার সুষ্ঠ তদন্তের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা হোক যেখানে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স এসোসিয়েশন (BMMOA)-এর ন্যুনতম ২জন প্রতিনিধিকে অর্ন্তভূক্ত করা হোক।

০৪। রকেট হামলার পর জাহাজটিতে মারাত্মকভাবে আগুন ধরে যাওয়ায় জাহাজটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হওয়ার আশংকা ছিল। কিন্তু সাহসিকতা ও বিরত্বের সাথে এই আগুন নিভানোই জাহাজটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। এই কারনে নাবিকদের এই বিরোচিত কার্যকলাপের জন্য নাবিকদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ও পুরষ্কার প্রদান করা হোক।